তাজুলের রাজত্বে থাবা বসাতে চায় আ.লীগ-বিএনপি

তাজুলের রাজত্বে থাবা বসাতে চায় আ.লীগ-বিএনপি


রংপুরের পাশাপাশি কুড়িগ্রামকেও জাতীয় পার্টির ঘাঁটি বলা হয়ে থাকে। তার মধ্যে কুড়িগ্রাম-২ আবার তাজুল ইসলামের আসন বলে পরিচিত। ১৯৭৯ থেকে এখন পর্যন্ত একবার ছাড়া আর কখনো কেউ থাবা বসাতে পারেনি এখানে। তবে এবার আসনটি ছিনিয়ে নিতে তৎপর আওয়ামী ও লীগ বিএনপি। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
তাজুলের রাজত্বে থাবা বসাতে চায় আ.লীগ-বিএনপি

সদর, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসনের এমপি তাজুল ইসলাম বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের চিফ হুইপ। জাতীয় পার্টির এই কেন্দ্রীয় নেতা দুই দশকের বেশি সময় ধরে রাজত্ব করছেন এলাকায়। আগামী সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থী হবেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য থেকে দেখা যায়,  ১৯৭৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা দুই দশক এমপি ছিলেন তাজুল ইসলাম। ২০০৮ সালে এ আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরাসরি নির্বাচন করে জয়ী হন। পরে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ফের বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
তবে আগামী নির্বাচনে তাজুল ইসলামের জয় পাওয়া সহজ হবে না বলে জানা যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলাকায় যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। এবারের বন্যার সময় এলাকায় ছিলেন না, চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করেন। দলের দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এদিকে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে চাইছে। মানুষের মাঝে তুলে ধরা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি।

তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ফুলকুমার ও ব্রহ্মপুত্রসহ ১৬টি নদ-নদীবেষ্টিত এই এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। বড় কোনো হাটবাজারও নেই এলাকায়। কৃষিনির্ভর মহকুমা শহরটি ‘এরশাদ’ সরকার জেলা শহরে উন্নীত করলেও গড়ে ওঠেনি কোনো বড় অবকাঠামো এবং শিল্পকারখানা।

এলাকার সঙ্গে কম যোগাযোগের কথা স্বীকার করে তাজুল ইসলাম বলেন,   রাজনৈতিক ব্যস্ততায় এলাকায় আসতে না পারলেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। জেলার সার্বিক উন্নয়ন, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যক্তিগতভাবে দুস্থদের সহায়তা করেছি। শুধু নির্বাচনী এলাকা নয়, কুড়িগ্রাম জেলাসহ গোটা দেশের হয়ে কাজ করেছি। জনগণের ভালোবাসাই আমার ভোট।’

এই আসনটি পেতে আওয়ামী লীগের তৎপরতার পাশাপাশি জাতীয় পার্টিতেও অনেক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হয়েছেন তাজুল ইসলামের বিপক্ষে।
জাতীয় পার্টির বিকল্প প্রার্থী হিসেবে ইতিমধ্যে সরব আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) আবদুস সালামের নাম। নির্বাচনী এলাকায় তিনি নিজেও সরব। গত নির্বাচনেই তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল। কিন্তু সরকারি চাকরি থেকে অবসরের তিন বছর পূর্ণ না হওয়ায় গত নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি তিনি। এবার দলের মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী আবদুস সালাম।

জাপার প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান পনির উদ্দিন আহমদের নাম। আগামী নির্বাচনে তিনি দলবদল করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হতে চান। গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি জাফর আলীর কাছে হেরে যান পনির উদ্দিন।

কুড়িগ্রািমের চার আসনের কোথাও আওয়ামী লীগের এমপি নেই। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাফর আলী দলীয় মনোনয়ন পেলেও মহাজোটের কারণে জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দিতে হয়। এবারও আসনটি ছেড়ে দিতে হয় কি না, তা নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা রাখতে মো. জাফর আলীকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। পরে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন তিনি।

আগামী নির্বাচনে সদর আসনটি পুনরায় জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলে দলের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন। তাই তারা আসনটি দলের জন্য রাখতে জোরালো তৎপরতা চালাচ্ছেন।

জানতে চাইলে মো. জাফর আলী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি।

স্বাধীনতার পর প্রথম ২০০৯ সালের উপনির্বাচনে এ আসনটি আওয়ামী লীগকে উপহার দেই। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে আগামী নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব।’

মো. জাফর আলী ছাড়াও অন্তত আরো সাতজন রয়েছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায়। তাদের অন্যতম সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আমসাআ আমিন, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আমিনুল ইসলাম মন্ডল, সহসভাপতি চাষী করিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন, সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ হাসান লোবান, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রহুল আমিন দুলাল, চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সুফিয়ান ও ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. হামিদুল হক খন্দকার। তাদের মধ্যে অনেকেই গণসংযোগও করছেন। অনেকেরই বিলবোর্ড ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে এলাকা।

কথা হয় সুবক্তা, গবেষক ও লেখক হিসেবে পরিচিত আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে। ফেলানী হত্যা মামলার আইনজীবী হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তিনি নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। রাকসুর সাবেক এজিএস ও তুখোড় এ ছাত্রনেতা বলেন, ‘গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে দলীয় প্রধানের কাছ থেকে মনোনয়ন চাইব। তবে দল যাকেই মনোনয়ন দেবে, তার হয়ে সর্বোচ্চ কাজ করব।’

এদিকে বিএনপি জোটের নেতাকর্মীরা বলছেন, বর্তমান সরকারের নানা ব্যর্থতার পাশাপাশি, খুন-গুম ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মানুষের ক্ষোভ পুঁজি করে এ আসনে বিএনপির প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়যুক্ত করার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

এই আসনটি দখলে নিতে বিএনপির শক্ত প্রার্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীকে। ২০০৬ সালের বাতিল ঘোষিত নির্বাচনে তিনি এ আসনে প্রার্থী ছিলেন। কুড়িগ্রাম শহরের চামড়াগোলা এলাকায় তার বাড়ি।

রহুল কবির রিজভী এ আসনে নির্বাচন করবেন কি না, তা স্পষ্ট না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বন্যায় কয়েক দফা ত্রাণ বিতরণ করায় নেতাকর্মী ও জনসাধারণের সঙ্গে তার যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েক দিন আগে কুড়িগ্রামে তার নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের ডেকে নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি।

এ ছাড়া এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা, কুড়িগ্রাম পৌরসভার সাবেক মেয়র আবু বকর সিদ্দিক, সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম বেবু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদের নাম শোনা যাচ্ছে।

বিএনপির এসব প্রার্থীর মধ্যে সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় জনসংযোগ করছেন। নির্বাচনী এলাকার সর্বত্রই রয়েছে তার বিলবোর্ড-পোস্টার। সরকারবিরোধী কর্মকা-ের অভিযোগে একাধিক মামলা বিচারাধীন তার বিরুদ্ধে।

সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জনসংযোগ করে পার্টির জনভিত্তি দাঁড় করিয়েছি। তৃণমূল নেতাকর্মীরা চান আমি নির্বাচন করি। তাই মনোনয়ন চাইব। কেন্দ্র যা ভালো মনে করবে, তা মেনে নেব।’

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment